বিষণ্নতা (Depression)

শেয়ার করুন

বর্ণনা

প্রত্যেক মানুষই কখনো না কখনো হতাশ ও বিমর্ষ হয়ে পড়ে। তবে এটি খুব বেশি সময়ের জন্য স্থায়ী হয় না এবং কয়েকদিনের মধ্যে এই হতাশা কেটে যায়। বিষণ্নতা কম বেশি সবার মাঝে দেখা গেলেও এটি একটি মারাত্মক মানসিক সমস্যা। কোনো মানুষ বিষণ্নতায় ভুগলে তা তার কাছের মানুষের জীবনেও বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি করে।

ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতা একটি মুড ডিজঅর্ডার। এর ফলে একজন ব্যক্তি প্রতিনিয়ত হতাশায় ভোগে ও জীবনের প্রতি অনাগ্রহ বোধ করে। এটি তার চিন্তাধারা ও আচরণের উপর প্রভাব ফেলে এবং অন্যান্য শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সৃষ্টি করে। এর ফলে দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন সমস্যা তৈরি হয় এবং এক পর্যায়ে আক্রান্ত ব্যক্তি বেঁচে থাকার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।

মানুষের মধ্যে কয়েক ধরনের বিষণ্নতা দেখা যায়। যেমনঃ

  • মেজর ডিপ্রেশন (Major Depression): এর ফলে একজন ব্যক্তির মধ্যে মারাত্মক কিছু লক্ষণ দেখা দেয়, যেগুলি তার দৈনন্দিন বিভিন্ন কাজকর্ম যেমন খাওয়া-দাওয়া, ঘুমানো ও পড়াশোনার উপর প্রভাব ফেলে। একজন ব্যক্তির জীবনে কেবলমাত্র একবার এ ধরনের বিষণ্নতা দেখা দিতে পারে, তবে অনেক ক্ষেত্রে প্রায় সময়ই এ সমস্যা একাধিকবার দেখা দেয়।
  • পারসিস্টেন্ট ডিপ্রেসিভ ডিজঅর্ডার (Persistent Depressive Disorder): এই ধরনের বিষন্নতা কমপক্ষে দুই বছর স্থায়ী হয়। পারসিস্টেন্ট ডিপ্রেসিভ ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে একাধিকবার মেজর ডিপ্রেশনের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তবে এক্ষেত্রে লক্ষণগুলো ততোটা মারাত্মক হয় না এবং অবশ্যই দুই বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়।

আবার কয়েক ধরণের বিষন্নতা আছে যেগুলো শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কোনো অবস্থায় পরিলক্ষিত হয়। যেমন:

সাইকোটিক ডিপ্রেশন (Psychotic depression): এ অস্থায় অন্যান্য মনোরোগ যেমন বিভ্রম (অবাস্তব কোনো কিছু কল্পনা করা) বা হ্যালুসিনেশন (অলীক কোনো কিছু শোনা বা দেখা) এর সাথে বিষণ্নতা দেখা দেয়।

পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন (Postpartum Depression): বাচ্চা হওয়ার পর একজন মহিলার মধ্যে শারীরিক ও হরমোনগত বিভিন্ন পরিবর্তন আসে। একই সাথে নবজাতকের লালন-পালনের দায়িত্বও নতুনভাবে যোগ হয়। এই সকল আকস্মিক পরিবর্তনের কারণে অনেক মহিলাই বিষন্নতায় ভোগে, যা পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন নামে পরিচিত। প্রায় ১০-১৫% মহিলা বাচ্চা হওয়ার পর এই ডিপ্রেশনে ভোগে।

সিজোনাল এফেক্টিভ ডিজঅর্ডার (Seasonal Affective Disorder): এটি সংক্ষেপে এস-এ-ডি (SAD) নামে পরিচিত। সিজোনাল এফেক্টিভ ডিজঅর্ডার প্রকৃতির সাথে সম্পর্কযুক্ত। শীতের শুরুতেই বিষণ্নতাজনিত লক্ষণগুলো দেখা দেয়, কেননা এ সময় প্রকৃতিকভাবেই সূর্যের আলোর পরিমাণ কম থাকে। বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে এই লক্ষণগুলো প্রকট আকার ধারণ করে। সাধারণত লাইট থেরাপির (Light therapy) সাহায্যে এর চিকিৎসা করা হয়। তবে অধিকাংশ রোগী শুধু লাইট থেরাপির সাহায্যে সুস্থ হয় না। এক্ষেত্রে থেরাপির সাথে এন্টিডিপ্রেসেন্ট ঔষধ ও সাইকোথেরাপি দেওয়া হয়।

বাইপোলার ডিজঅর্ডার (Bipolar disorder): এর ফলে একজন ব্যক্তির মানসিক অবস্থার বারবার পরিবর্তন হয়। তবে মেজর ডিপ্রেশন ও পারসিস্টেন্ট ডিপ্রেসিভ ডিজঅর্ডা্রের মতো বাইপোলার ডিজঅর্ডার খুব বেশি মাত্রায় দেখা যায় না। এটি ম্যানিয়াক-ডিপ্রেসিভ ইলনেস (Maniac-dispersive disorder) নামেও পরিচিত।

কারণ

শারীরিক, মানসিক, পারিপার্শ্বিক ও জিনগত বিভিন্ন সমস্যার কারণে বিষন্নতা দেখা দিতে পারে। তবে ঠিক কি কারণে একজন ব্যক্তি বিষন্নতায় ভোগে তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। নিম্নে বিষণ্নতার বিভিন্ন কারণ সম্পর্কে আলোচনা করা হলোঃ

  • মস্তিষ্কে কোনো কারনে গঠনগত পরিবর্তন আসলে বিষন্নতা দেখা দেয়।
  • মস্তিষ্কের বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদানের (Neurotransmitters) ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেলে বিষণ্নতাজনিত লক্ষণ দেখা দেয়।
  • দেহে হরমোনের ভারসাম্যে ত্রুটি দেখা দিলে বিষণ্নতা হতে পারে।
  • যেকোনো দুর্ঘটনা বা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যেমন কাছের মানুষের মৃত্যু, অর্থনৈতিক সমস্যা বা শৈশবের কোনো আঘাতের কারণে মানসিক চাপের সৃষ্টি হতে পারে এবং বিষণ্নতার সূত্রপাত ঘটতে পারে।
  • পূর্বে কখনো শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন বা যৌন হয়রানির শিকার হলে বিষণ্নতাজনিত লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
  • নির্দিষ্ট কিছু ঔষধ যেমন Accutane এবং corticosteroids ব্যবহারের কারণে বিষন্নতা দেখা দেওয়ার ঝুঁকি বাড়তে পারে।
  • জিনগত ও বংশগত কারণে কোনো ব্যক্তি বিষন্নতায় ভুগতে পারে। যদিও জিনগত কারণ বিষণ্নতার সাথে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত নয়, তবে অনেক ক্ষেত্রে একই পরিবারের বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে বিষণ্নতাজনিত লক্ষণ দেখা যায়।
  • কোনো ইতিবাচক ঘটনা যেমন নতুন চাকরি, বিয়ে এবং নেতিবাচক ঘটনা যেমন চাকরি থেকে অবসর নেয়া, আর্থিক সংকট বা বিবাহ-বিচ্ছেদের কারণে জীবনে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন আসলে  একজন ব্যক্তি মানসিক চাপের সম্মুখীন হয় এবং বিষণ্নতায় ভোগে।
  • গুরুতর কোনো শারীরিক সমস্যা থাকলেও বিষণ্নতা দেখা দিতে পারে।
  • মাদকদ্রব্য ব্যবহারের কারণে প্রায় ৩০% মানুষের মধ্যে বিষণ্নতা দেখা দেয়।

লক্ষণ

চিকিৎসকেরা এই রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তিদের মধ্যে সাধারণত নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দেখতে পানঃ

চিকিৎসা

চিকিৎসকেরা এই রোগাক্রান্ত ব্যক্তিদের নিম্নের ঔষধগুলো দিয়ে থাকেনঃ

amitriptyline aripiprazole
bupropion hydrochloride citalopram hydrobromide
clomipramine hydrochloride doxepin hydrochloride
duloxetine hydrochloride escitalopram oxalate
fluoxetine hydrochloride fluvoxamine maleate
imipramine hydrochloride lithium carbonate
mirtazapine nortriptyline
paroxetine hydrochloride selegiline
sertraline hydrochloride venlafaxine hydrochloride

চিকিৎসকেরা এই রোগাক্রান্ত ব্যক্তিদের নিম্নের টেস্টগুলো দিয়ে থাকেনঃ

ব্লাড ইউরিয়া নাইট্রোজেন, বি-ইউ-এন (Blood Urea Nitrogen, BUN)
ক্রিয়েটিনিন, সেরাম (Creatinine, Serum)
ইলেক্ট্রোলাইটস, সেরাম (Electrolytes, serum)
লিভার ফাংশন টেস্ট (Liver function tests)
সি-বি-সি (কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট) (CBC, Complete Blood Count)
টি-এস-এইচ (TSH)
সাইকোথেরাপী (Psychotherapy)
মেন্টাল হেলথ কাউন্সেলিং (Mental health counseling)
ডিপ্রেশন স্ক্রিনিং (Depression screen)

ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়

সাধারণত ২০-৩০ বছর বয়সের দিকে এবং বয়ঃসন্ধিকালে বিষণ্নতা বেশি দেখা দেয়। তবে পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের এ সমস্যা বেশি হয়ে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, বিভিন্ন কারণে বিষণ্নতায় ভোগার ঝুঁকি বাড়তে পারে এবং বিষণ্নতা মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। যেমন:

  • শৈশব ও বয়ঃসন্ধিকাল থেকেই কোনো ব্যক্তি বিষণ্নতায় ভোগা।
  • মাদকদ্রব্য ব্যবহার ।
  • গুরুতর শারীরিক সমস্যা যেমন ক্যান্সার, ডায়াবেটিস বা হৃদরোগ থাকা।
  • উচ্চ রক্তচাপের জন্য ব্যবহৃত ঔষধ বা ঘুমের ঔষধ ব্যবহার।
  • দুর্ঘটনা বা কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সম্মুখীন হওয়া।
  • পরিবারের কারো বিষণ্নতা, বাইপোলার ডিজঅর্ডার ও মাদকের ব্যবহারজনিত সমস্যা থাকা।

যারা ঝুঁকির মধ্যে আছে

লিঙ্গঃ মহিলাদের মধ্যে এই রোগ নির্ণয়ের গড়পড়তা সম্ভাবনা রয়েছে। পুরুষদের মধ্যে এই রোগ নির্ণয়ের সম্ভাবনা ১ গুণ কম।

জাতিঃ শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে এই রোগ নির্ণয়ের গড়পড়তা সম্ভাবনা রয়েছে। অপরদিকে কৃষ্ণাঙ্গ, হিস্প্যানিক ও অন্যান্য জাতির মধ্যে এই রোগ নির্ণয়ের সম্ভাবনা  ১ গুণ কম।

সাধারণ জিজ্ঞাসা

উত্তরঃ এটি বিভিন্ন কারণে হতে পারে। বয়ঃসন্ধির পূর্বে ছেলে ও মেয়ে উভয়ের মধ্যে বিষণ্নতা প্রায় একই মাত্রায় কাজ করে। তবে বয়ঃসন্ধির পর মেয়েদের মধ্যে যেসব শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন আসে সেগুলির কারণে মেয়েদের মধ্যে বিষন্নতাজনিত লক্ষণ বেশি দেখা যায়। আবার কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সম্মুখীন হলে ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা বেশি হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়ে এবং বিষণ্নতায় ভুগতে থাকে।

উত্তরঃ মেনোপজের সময় মহিলাদের মধ্যে বিষন্নতা দেখা দেওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি থাকে। মেনোপজের পর এস্ট্রোজেনসহ অন্যান্য হরমোনের পরিমাণ ক্রমাগতভাবে কমতে থাকে। এর ফলে মস্তিষ্কের রাসায়নিক ক্রিয়ার উপর প্রভাব পড়ে এবং বিষণ্নতাজনিত বিভিন্ন লক্ষণ দেখা দেয়।

উত্তরঃ বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে প্রথমবারের মত বিষণ্নতা দেখা দিলে তার কারণ হল বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন, যেমন-  বয়স্ক ব্যক্তিদের স্বাভাবিক রক্ত প্রবাহের ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়, যা ইশকেমিয়া (Ischemia) নামে পরিচিত। আবার সময়ের সাথে সাথে দেহের রক্তনালীসমূহের নমনীয়তা হ্রাস পায়। যার ফলে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গসহ মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহ ব্যাহত হয়।

হেলথ টিপস্‌

শিশুদের মধ্যে বিষণ্নতা দেখা দিলে এ ব্যাপারে বিশেষ যত্নশীল হতে হবে। কেননা এর ফলে শিশু মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে ও তাদের দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয়।

নিম্নলিখিত উপায় অবলম্বনে এ অবস্থার দ্রুত উন্নতি হয়:

  • চিকিৎসা চলাকালীন  চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে। সেশন সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত সাইকোথেরাপি নেওয়া বন্ধ করা যাবে না।
  • নিজের অবস্থা সম্পর্কে জানতে হবে ও সচেতন হতে হবে।
  • যেসব কারণে বিষণ্নতা দেখা দিতে পারে সেগুলো সম্পর্কে জানতে হবে ও সচেতন হতে হবে।
  • নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। শারীরিক পরিশ্রমের সাহায্যে বিষণ্নতাজনিত লক্ষণগুলো থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে প্রতিদিন হাঁটাহাঁটি, দৌড়ানো বা সাঁতার কাটা যেতে পারে।
  • প্রতিদিন পরিমিত পরিমাণ খাদ্যগ্রহণের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
  • মাদক ও নেশাজাতীয় দ্রব্যের ব্যবহার পরিহার করতে হবে। মাদক ব্যবহারের মাধ্যমে সাময়িকভাবে বিষণ্নতা থেকে মুক্তি পাওয়া গেলেও এটি পরবর্তীতে বিরূপ প্রভাব ফেলে।
  • পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমাতে হবে যা বিষন্নতা থেকে মুক্তি পাওয়ার অন্যতম প্রধান উপায়।

বিশেষজ্ঞ ডাক্তার

ডাঃ মোঃ জিল্লুর রহমান খাঁন(রতন)

সাইকিয়াট্রি ( মানসিক) ( Psychiatry)

এমবিবিএস,, এমপিএইচ(ইপিড),, এফসিপিএস(সাইকিয়াট্রি)

ক্যাপ্টেন ডাঃ এ এস এম আনিসুজ্জামান

সাইকিয়াট্রি ( মানসিক) ( Psychiatry)

এমবিবিএস (ঢাকা), ডি-সাইক, এফ-সাইক (ভিয়েনা)

অধ্যাপক ডাঃ সাহিদা চৌধুরী

সাইকিয়াট্রি ( মানসিক) ( Psychiatry)

এমবিবিএস, ডিপিএম

ডাঃ মোঃ খায়রুল বাশার

সাইকিয়াট্রি ( মানসিক) ( Psychiatry)

এমবিবিএস, বিসিএস(স্বাস্থ্য), এমসিপিএস, এফসিপিএস(সাইকিয়াট্রি)

অধ্যাপক ডাঃ মোঃ ওয়াজিউল আলম চৌধুরী

সাইকিয়াট্রি ( মানসিক) ( Psychiatry)

এমবিবিএস, , এমএসিপি(আমেরিকা), , এফসিপিএস(সাইক)

ডাঃ মোঃ জুবায়ের মিয়া

সাইকিয়াট্রি ( মানসিক) ( Psychiatry)

এমবিবিএস, এমফিল(সাইকিয়াট্রি)

অধ্যাপক ডাঃ মোঃ আহসানুল হাবীব

সাইকিয়াট্রি ( মানসিক) ( Psychiatry)

এমবিবিএস, , এফসিপিএস(সাইক্রিয়াট্রি)

প্রফেসর কর্ণেল এম. কামরুল হাসান

সাইকিয়াট্রি ( মানসিক) ( Psychiatry)

এমবিবিএস, এমসিপিএস, এমফিল